IQNA

চির-সমুন্নত মহামানব 'মহানবীর (সা) প্রাণ' হযরত আলী (আ)

19:37 - March 21, 2019
সংবাদ: 2608174
বিশ্বনবী (সা.)'র একটি হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী(আ.)কে পুরোপুরি বা পরিপূর্ণভাবে চেনেন কেবল আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.) এবং আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূলকে সবচেয়ে ভালভাবে চেনেন কেবল আলী (আ.)। আলী (আ.) এমন এক নাম যাঁর নাম উচ্চারণ ও যাঁর বরকতময় জীবনের আলোচনা মানুষের ঈমানকে তাজা করে দেয়। মহানবী (সা.) একবার বলেছিলেন, আমি যদি আলীর প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরি তাহলে লোকেরা আলীকে সম্মান দেখাতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করবে।

বার্তা সংস্থা ইকনা: হযরত আলী (আ.)'র আকাশ-ছোঁয়া বীরত্ব ও মহত্ত্ব কেবল মুসলিম কবি, সাহিত্যিক বা মনীষীদেরই প্রভাবিত করেনি, অমুসলিম পণ্ডিতরাও তার সুবিশাল ব্যক্তিত্বের ব্যাপকতায় অভিভূত ও হতবাক হয়েছেন। তাঁর মহত্ত্ব ও উদারতার প্রশংসা করে আর ডি ওসবোর্ন বলেছেন, আলী (আ.) ছিলেন মুসলমানদের ইতিহাসের সর্বোত্তম আত্মার অধিকারী সর্বোত্তম ব্যক্তি। ওয়াশিংটন আরভিং বলেছেন, "সব ধরনের নীচতা ও কৃত্রিমতা বা মিথ্যার বিরুদ্ধে আলী (আ.)'র ছিল মহৎ সমালোচনা এবং আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রিক সব ধরনের কূটচাল থেকে তিনি নিজেকে দূরে রেখেছিলেন।"

ঐতিহাসিক মাসুদির মতে, রাসূল (সা.)'র চরিত্রের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল যার ছিল তিনি হলেন আলী (আ.)।

আমীরুল মুমিনীন আলী সম্পর্কে মাওলানা রুমী লিখেছেন,

“সাহসিকতায় তুমি ছিলে খোদার সিংহ তা জানি

পৌরুষত্বে আর বদান্যতায় কি তুমি তা জানেন শুধুই অন্তর্যামী।”

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের অতুলনীয় ও শ্রেষ্ঠ বীরযোদ্ধা। আল্লাহর সিংহ বা আসাদুল্লাহ ছিল তাঁর উপাধি। বিশ্বনবীর জীবদ্দশায় প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে বিজয়ের তিনিই ছিলেন প্রধান স্থপতি। তাই বলা হয়, হযরত আলী (আঃ)’র তরবারি জুলফিক্বার ছাড়া ইসলামের কোনো বিজয়ই অর্জিত হতো না। বিশ্বনবী-সা:নিজেই তাঁকে এই দ্বিধারী তরবারি উপহার দিয়েছিলেন। বদর, ওহোদ, খন্দক, খায়বারসহ অনেক যুদ্ধের কিংবদন্তীতুল্য বীর আলী (আ.) অনেকবার নিজ জীবন বাজি রেখে রাসূল (সা:)’র জীবন রক্ষা করেছিলেন। জিহাদের ময়দানে তাঁর উপস্থিতিই শত্রু-সেনার মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতো।

 

ভারত উপমহাদেশের বিশিষ্ট সূফী সাধক খাজা মুঈনউদ্দিন চিশতি (র.) বলেছেন,সমুদ্রকে যেমন ঘটিতে ধারণ করা অসম্ভব তেমনি বর্ণনার মাধ্যমে আলী (আ.)'র গুণাবলী তুলে ধরাও অসম্ভব।

হযরত আলী (আ.)'র চরিত্রে আমরা দেখতে পাই একজন দার্শনিকের বৈশিষ্ট্য, একজন বিপ্লবী নেতার বৈশিষ্ট্য, একজন সূফী শায়খের বৈশিষ্ট্য এবং নবী-রাসূলদের মধ্যে যেসব বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ থাকে তারও অনেক বৈশিষ্ট্য।

সুন্নি হাম্বালি মাজহাবের প্রধান তথা ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল বলেছেন, হযরত আলী সম্পর্কে যত বেশি প্রশংসা বা ফজিলতের হাদিস দেখা যায় আর কোনো সাহাবি সম্পর্কে এত বেশি সংখ্যক ফজিলতের হাদিস দেখা যায় না। একবার তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, শ্রেষ্ঠ সাহাবির মধ্যে আলী আছেন কিনা। এর উত্তরে ইমাম হাম্বাল বলেন, তিনি তো সাহাবিদের অনেক ঊর্ধ্বে, তিনি তো মহানবীর প্রাণ!

নিজের শাসনামলে ওমর ইবনে খাত্তাব নানা জ্ঞানগত সূক্ষ্ম বিষয়ে আলীর সহায়তা নিতে বাধ্য হওয়ার কারণে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বার বার বলেছেন, আলী না থাকলে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত। তিনি বলেছিলেন, আলীর মত আরেকজনকে গর্ভে ধারণ ও প্রসব করার ক্ষমতা নারীকুলের কারো নেই। ইবনে মাজাহ হাদিস গ্রন্থে এসেছে, মহানবী (সা)বলেছেন, আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে এবং আলী ছাড়া অন্য কেউই আমার প্রতিনিধি নয়।

মহানবীর জীবনী সম্পর্কে সুন্নি ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম লিখেছেন, হযরত আলীই ছিলেন সর্বপ্রথম পুরুষ যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। পুরুষদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম মহানবীর সঙ্গে নামাজ আদায় করেছেন।

কানজুল উম্মাল হাদিস গ্রন্থে এসেছে, মহানবী হযরত ফাতিমাকে বলেছেন, আমি তোমাকে বিয়ে দিচ্ছি আমার উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সঙ্গে, সে ধৈর্যে সর্বোত্তম এবং প্রথম মুসলমান। বুখারির হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা) আলীকে বলেছেন, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হচ্ছে মুসার সঙ্গে হারুনের সম্পর্কের অনুরূপ। শুধু পার্থক্য হল হারুন নবী ছিলেন কিন্তু তুমি নবী নও।

হাদিস গ্রন্থ তিরমিজিতে বলা হয়েছে, মহানবী বলেছেন, আলী আমা থেকে ও আমি আলী থেকে এবং আলী হচ্ছে আমার পর প্রত্যেক মুমিনের অভিভাবক।

ইমাম তাবারি ও সুয়ুতিসহ অনেক প্রখ্যাত সুন্নি মনীষী এ হাদিসটি উল্লেখ করেছেন যে মহানবী বলেছেন, আমি জ্ঞানের শহর ও আলী তার দরজা। যে জ্ঞান অর্জন করতে চায় তাকে এ দরজা দিয়েই প্রবেশ করতে হবে।

কথিত আছে রাসূলে পাক (সা:)’র স্ত্রী আয়শা বিনতে আবুবকর হযরত আলী (আঃ)’র শাহাদতের খবর শুনে অত্যন্ত শোকার্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হে রাসূল!তোমার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র শাহাদত বরণ করেছেন। আজ এমন এক ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন যিনি ছিলেন রাসূল (সা.)'র পর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।' আর মহানবীর অন্যতম শশুর আবুবকর বলেছেন, আমি রাসুলের কাছে শুনেছি আলীর চেহারার দিকে তাকানোও ইবাদত।

হযরত আলী সম্পর্কে মহানবী আরও বলেছেন: হে আম্মার! যদি দেখ সমস্ত মানুষ একদিকে চলে গেছে, কিন্তু আলী চলে গেছে অন্য দিকে, তবুও আলীকে অনুসরণ কর,কারণ, সে তোমাকে ধ্বংসের দিকে নেবে না। মহানবীর বলেছেন, সত্য ও কুরআন সব সময়ই আলীর সঙ্গে থাকবে।

বিশ্বনবী (সা:) আরও বলেছেন: আমি আলী থেকে, আর আলী আমার থেকে, যা কিছু আলীকে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা কিছু আমাকে কষ্ট দেয় তা আল্লাহকে কষ্ট দেয়। হে আলী! ঈমানদার কখনও তোমার শত্রু হবে না এবং মোনাফেকরা কখনও তোমাকে ভালবাসবে না।

অনেক সাহাবী এ হাদিসের ভিত্তিতেই মোনাফেকদের সনাক্ত করতেন।

হযরত ইবনে আব্বাস বলেছেন, আলীর চারটি গুণ ছিল যা অন্য কারো ছিল না। আরব ও অনারবের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি রাসূলের সাথে সালাত আদায় করেছেন। দ্বিতীয়ত: প্রত্যেক জিহাদেই তাঁর হাতে ঝাণ্ডা থাকতো। তৃতীয়ত: লোকেরা যখন রাসূলের কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়ে যেত তখনও আলী তাঁর পাশেই থাকতো। চতুর্থত: আলীই রাসূল (সা:)কে শেষ গোসল দিয়েছিলেন এবং তাঁকে কবরে রাখেন।

জীরার ইবনে হামজা তাঁর প্রিয় নেতা আলী সম্পর্কে বলেছিলেন, "আলীর ব্যক্তিত্ব ছিল সীমাহীন, তিনি ক্ষমতায় ছিলেন দোর্দণ্ড, তাঁর বক্তব্য ছিল সিদ্ধান্তমূলক, তাঁর বিচার ছিল ন্যায়-ভিত্তিক, সব বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল, তাঁর প্রতিটি আচরণে প্রজ্ঞা প্রকাশ হত। তিনি মোটা বা সাদামাটা খাদ্য পছন্দ করতেন এবং অল্প দামের পোশাক পছন্দ করতেন। আল্লাহর কসম, তিনি আমাদের একজন হিসেবে আমাদের মাঝে ছিলেন, আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন, আমাদের সকল অনুরোধ রক্ষা করতেন। তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও তাঁকে সম্বোধন করে কিছু বলতে ও প্রথমে কথা বলতে আমরা ভয় পেতাম না। তাঁর হাসিতে মুক্তা ছড়িয়ে পড়তো। তিনি ধার্মিকদের খুব সম্মান করতেন। অভাবগ্রস্তের প্রতি খুবই দয়ালু ছিলেন। এতিম, নিকট আত্মীয় ও অন্নহীনকে খাওয়াতেন। তিনি বস্ত্রহীনে বস্ত্র দিতেন ও অক্ষম ব্যক্তিকে সাহায্য করতেন। তিনি দুনিয়া ও এর চাকচিক্যকে ঘৃণা করতেন । আমি আলী ইবনে আবি তালিবকে গভীর রাতে বহুবার এ অবস্থায় মসজিদে দেখেছি যে তিনি নিজ দাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে এমনভাবে আর্তনাদ করতেন যেন সাপে কামড় খাওয়া মানুষ এবং শোকাহত লোকের মতো রোদন করে বলতেন, হে দুনিয়া, ওহে দুনিয়া, আমার কাছ থেকে দূর হও! আমাকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করো না!" .. .. .. এরপর জীরার বলেন, আলী (আঃ)'র অনুপস্থিতিতে আমি সেই মহিলার মতো শোকাহত যার সন্তানকে তার কোলে রেখে কেটে ফেলা হয়েছে।

আলী (আ.)ই ছিলেন ইসলামী যুক্তি-ভিত্তিক দর্শনের প্রথম প্রচলনকারী। কুরআনের এমন কোনো আয়াত নেই যার বিশদ ব্যাখ্যা, শানে-নজুল ইত্যাদি নিয়ে তিনি রাসূলের সঙ্গে আলোচনা করেননি। কুরআনের বাহ্যিক শব্দগুলোকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনিই প্রথম আরবি ব্যাকরণ শাস্ত্র রচনা করেন।

মানুষের মনে উত্তেজনা ও প্রভাব সৃষ্টিতে আমিরুল মু' মিনিন আলী (আ.)'র সুবিশাল ব্যক্তিত্ব ও মহত্ত্ব ইতিহাসে দখল করে আছে অনন্য ও শীর্ষস্থানীয় এক বিশেষ অবস্থান। বিশ্বনবী (সা.)'র পর এ ব্যাপারে তিনি সত্যিই অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুতাহ্‌হারি (র.) লিখেছেন:

'আমিরুল মু' মিনিন হযরত আলী (আ.)'র মহৎ ও সুন্দর ব্যক্তিত্ব এত বিশাল বিস্তৃত ও এত বিচিত্রময় যে একজন মানুষের পক্ষে তাঁর সব বৈশিষ্ট্য ও পরিধি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করাও সম্ভব নয়। মানুষ কল্পনার ফানুস উড়াতে পারবে কিন্তু এর কিনারার নাগালও পাবে না।'

আলী (আ.) জিহাদ থেকে ফিরে আসলে মহানবী (সা.) তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে যেতেন এবং তাঁর মুখের ঘাম মুছে দিতেন নিজ হাতে। তাঁকে জিহাদ বা সফরের সময় বিদায় দিতে গিয়ে তাঁর বিজয়ের জন্য দোয়া করতেন এবং বলতেন: হে আল্লাহ, আলীর সঙ্গে এটাই যেন আমার শেষ দেখা না হয় কিংবা বলেছেন: হে আল্লাহ, আমার মৃত্যুর আগে আলীকে যেন আরও একবার দেখতে পারি ।

আলী (আ.) বলেছেন, উট-শাবক যেমন মায়ের পিছে পিছে থেকে সব সময় মাকে অনুসরণ করে আমিও শৈশব থেকেই রাসূল (সা.)-কে সেভাবে অনুসরণ করতাম। রাসূল শৈশবে আমাকে কোলে নিতেন, খাইয়ে দিতেন, ঘুম পাড়িয়ে দিতেন ও বুকে চেপে ধরতেন। রাসূলের (সা.) কাছে ওহি নাজিল হওয়ার সময় আমিও দেখতে পেতাম ফেরেশতাদের।

অন্য অনেক সাহাবি অমুসলিম জীবনে মূর্তি পূজা করলেও হযরত আলী মুসলমান হওয়ার আগেও কখনও মূর্তি পূজা করেননি এবং মদ পান করেননি। মহানবীর আহলে বাইতের সদস্য ও নিষ্পাপ হওয়ার জন্য এটা জরুরি ছিল। মহান আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এ জন্য যে তিনি মানব জাতিকে হযরত আলী (আ.)'র মত একজন মহামানব উপহার দিয়েছেন।

এবারে হযরত আলী (আ.)'র প্রবাদতুল্য দু’টি বাণী তুলে ধরছি:

*বাহ্যিক অলংকার ও পোশাক-পরিচ্ছদ সৌন্দর্য নয়, সৌন্দর্য হল-জ্ঞান ও সভ্যতা। যার পিতা-মাতা মারা গেছে সে এতীম নয়, প্রকৃত এতীম সে যার মধ্যে জ্ঞান ও বিবেক নেই।

*সত্যকে আঁকড়ে ধর, যদি তাতে তোমার ক্ষতিও হয় এবং মিথ্যাকে বর্জন কর যদি মিথ্যা দিয়ে তোমার লাভও হয়। আর এটাই হল ঈমান।

আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলীর জন্মদিনে সবাইকে জানাচ্ছি আবারও অভিনন্দন। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এ মহামানবের অনুরাগী ও অনুসারী হওয়ার তৌফিক দিন। আমিন। #

পার্সটুডে

captcha